রমাদান ঈমানদারদের জন্য প্রশিক্ষণের মাস৷

মহান আল্লাহ তায়ালা মানবজাতিকে সৃষ্টি করে তাদের চলার পথ দেখিয়েছেন। ভালো ও মন্দের দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। ভালোর ফল নিয়ামতভরা সীমাহীন জান্নাতের সুসংবাদ দিয়েছেন। আর মন্দের ফল আগুনেভরা সীমাহীন জাহান্নামের খবর জানিয়েছেন। মানবজাতির জন্য যুগে যুগে নবী-রাসূল সা.-গণকে পাঠিয়ে আল্লাহ তায়ালা বাস্তব জীবনে জান্নাতের পথনির্দেশনা দিয়েছেন। আর জাহান্নামেরও অশুভ খবর জানিয়েছেন।
আজকের জীবনেও বিজ্ঞানের মহা আবিষ্কারের পরও আল্লাহর পাঠানো শেষ নবী সা. ও সর্বশেষ মহাগ্রন্থ আল কুরআন আমাদের সঠিক দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন এবং কিয়ামত পর্যন্ত এ সিলসিলা চালু থাকবে।
আমাদের সামনে বছরের শ্রেষ্ঠ মাস রমাদান আল্লাহর বান্দাদের জন্য গুনাহ মাফ ও জান্নাতের সুসংবাদ নিয়ে হাজির হয়েছে। আমরা যারা মহান আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছি ঈমানের বলে বলীয়ান হয়ে, তারই দেয়া জীবনবিধান অনুসরণ করে মহানবী সা.-এর দেখানো দিকনির্দেশনা অনুযায়ী নিজে চলতে চাই, অন্যকেও চলার আহ্বান জানাতে চাই।
মহান আল্লাহ তায়ালা সূরা মুমিনুনে মুমিনদের সফলকামের নিশ্চয়তা দিয়েছেন, যাতে তারা নিজেদের নামাজে বিনয়াবনত হয়। মহান আল্লাহ তায়ালা তার শেষ নবী মুহাম্মদ সা.-কে মিরাজে নিয়ে আমাদের জন্য পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ করে দিয়েছেন। ওই সময় থেকে কিয়ামত পর্যন্ত খুশু-খুজুর সাথে পাঁচ ওয়াক্ত ফরজ নামাজের বিধান কার্যকর থাকবে। রমাদানের রোজার সাথে পাঁচ ওয়াক্ত ফরজ নামাজের সাথে ঈমানদারদের অধিকতর প্রশিক্ষণের জন্য তারাবির নামাজ, কিয়ামুল লাইলের নামাজ পড়ার ব্যাপারে আল্লাহর নবী তাগাদা দিয়েছেন। সূরা মুয্যাম্মিলে আল্লাহ তায়ালা শেষ রাতে নামাজের ব্যাপারে গুরুত্ব দিয়েছেন। শুধু তাই নয়, মহান আল্লাহ রাতের শেষ ভাগে প্রতিদিন তার প্রিয় বান্দাদের অভাব-অভিযোগ, চাওয়া-পাওয়া শোনার জন্য নিম্ন আকাশে নেমে আসেন।
রমাদান মাসে বান্দাদের সওয়াবের পরিমাণ সীমাহীন গতিতে আল্লাহ বাড়িয়ে দেন। সাধারণত সওয়াবের পরিমাণ দশ থেকে সাতশত গুণ বাড়িয়ে দেন। কিন্তু রমাদান মাসে রোজা যেহেতু শুধুমাত্র আল্লাহর জন্য নিবেদিত, তাই তিনি এর সওয়াব নিজ হাতেই বণ্টন করবেন। আমরা আশা করতে পারি রমাদান মাসে আমাদের গুনাহ-খাতা মাফ হবে ইনশাআল্লাহ। কারণ মহানবী সা. বলেছেন, যারা রমাদান মাস পেয়েও তাদের গুনাহ-খাতা মাফ করাতে পারল না, তাদের জন্য লা’নত বা অভিসম্পাত।
নামাজের ব্যাপারে আমাদের আরো সচেতন ও সজাগদৃষ্টি রাখতে হবে। রমাদানের সময় পাঁচ ওয়াক্তের নামাজই জামায়াতে পড়ার আপ্রাণ চেষ্টা করতে হবে। বাংলাদেশের শহরে-বন্দরে, গ্রামে-গঞ্জে সব জায়গায়ই মসজিদের অভাব নেই। সুযোগ-সুবিধাও প্রচুর। তাই খুশু-খুজুর সাথে কায়মনোবাক্যে ধৈর্যের সাথে বিনয়াবনত হয়ে নামাজ আদায় করতে হবে। নামাজে দাঁড়িয়ে বাদশাহর বাদশাহ মহান আল্লাহকে সামনে রেখে দুনিয়ার সব কাজ দূরে রেখে একমাত্র তাঁরই গুণগান গাইতে হবে। সেজদায় পড়ে মনের সব চাওয়া চাইতে হবে। মহান আল্লাহ আমাদের সব চাওয়া পূরণ করে দেবেন, ইনশাআল্লাহ।
আমাদের ঈমানদারদের বাজে কথা বা অপ্রয়োজনীয় কাজ, অর্থহীন কাজ থেকে বিরক্ত থাকতে হবে। কোনোভাবেই সময় বা পয়সা বেহুদা কাজে ব্যয় করা যাবে না। কারণ দুনিয়ার সময় খুবই সীমিত। মহাসমুদ্রের মধ্যে এক ফোঁটা পানি যেমন নগণ্য, তেমনই আখিরাতের তুলনায় দুনিয়া এক ফোঁটা পানির সমতুল্য। তাই বাজে সময় বা কাজ থেকে বিরত থাকতেই হবে ঈমানদারদের। সূরা আল ফুরকানের ৭২ নং আয়াতে বলা হয়েছে, ‘যখন এমন কোনো জায়গা দিয়ে তারা চলে, যেখানে বাজে কথা হতে থাকে অথবা বাজে কাজের মহড়া চলে, তখন তারা ভদ্রভাবে সে জায়গা অতিক্রম করে চলে যায়।’ মুমিন ব্যক্তি অত্যন্ত ভারসাম্য জীবনযাপন করবে। অর্থহীন, অযথা আনন্দ-ফুর্তি, গালিগালাজ, পরনিন্দা, পরচর্চা, অপবাদ, মিথ্যা বর্জন, অশ্লীল কথাবার্তা, গান-বাজনা সব থেকে দূরে থাকতে হবে। জান্নাত সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘সেখানে তুমি কোনো বাজে কথা শুনতে পাবে না।’
মুমিনের আরেকটা গুণ, তারা জাকাতের পথে সক্রিয় থাকে। অর্থাৎ মুমিনের ধন-সম্পদের পবিত্রতা-পরিচ্ছন্নতা বা পবিত্র করার দায়িত্ব পালন করে। ধনীদের সম্পদে আল্লাহ তায়ালার নির্ধারিত গরিবদের হক যথাযথভাবে আদায় করে। নিজেদের মালের পরিশুদ্ধ করার সাথে সাথে অন্যদেরও তাদের মালের পরিশুদ্ধ করার আহ্বান করে। ব্যক্তি, সমাজ এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে জাকাত আদায়ের ব্যাপারে সক্রিয় থেকে আদায়কৃত অর্থ আল্লাহর নির্ধারিত ৮ খাতে ব্যয়ের সুষ্ঠু পরিকল্পনা করে এবং বাস্তবায়নের ব্যাপারে সক্রিয় থাকে।
মুমিন ব্যক্তি নিজেদের লজ্জাস্থানের হেফাজত করে। নিজেদের স্ত্রীদের ও অধিকারভুক্ত বাদীদের ছাড়া। তবে যারা এর বাইরে কিছু করবে, তারাই হবে সীমালঙ্ঘনকারী। দুনিয়ায় মানবসমাজের বিপর্যয়ের অন্যতম কারণ বিবাহবহির্ভূত মহিলাদের সাথে সম্পর্ক করা এবং জীবনযাপন করা। প্রাচ্যে এবং পাশ্চাত্যে ব্যক্তিস্বাধীনতার নামে ছেলেমেয়েদের অবাধ মেলামেশা, যৌন সম্পর্ক স্থাপন করা, লিভ টুগেদার করা একেবারেই মামুলি ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে; যা ইসলামে একেবারেই নিষিদ্ধ বা হারাম বলে বিবেচিত। স্বামী-স্ত্রীর বৈধ সম্পর্কের মাধ্যমেই ছেলেমেয়ের জন্মগ্রহণ, বিয়েশাদি হওয়া, সামাজিক সুষ্ঠু পরিবেশ গঠনে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করে। ছেলেমেয়ের অবৈধ সম্পর্ক এবং অবাধ মেলামেশার ব্যাপারে সীমালঙ্ঘনের পর্যায়ে যাওয়া কোনোমতেই ঈমানদাররের জন্য শুভ কাজ নয়। আল্লাহ ও রাসূল সা. নির্ধারিত পথেই স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের ফলে সমাজ ও রাষ্ট্রের কল্যাণ বয়ে আনতে পারে।
মুমিন ব্যক্তিরা নিজেদের আমানত ও প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে। এখানে ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রের আমানত ও প্রতিশ্রুতি রক্ষার ব্যাপারে সজাগ-সচেতন হওয়া অত্যন্ত জরুরি। শুধুমাত্র টাকা-পয়সার আমানত নয়। দায়িত্বের আমানতও এখানে আলোচ্য বিষয়। যার যত ক্ষমতা বা সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব, তার তত বেশি আমানতের হিসাব দিতে হবে। রাষ্ট্রপ্রধান থেকে শুরু করে এমপি, মন্ত্রী, দলীয় পদ-পদবি, আমলা, সাধারণ কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের থেকে শুরু করে ব্যক্তিজীবনের সব দায়িত্বের আমানতের হিসাব পুরোপুরি দিতে হবে। সূরা যিলযালের শেষ দুই আয়াতে এ ব্যাপারে সতর্ক করা হয়েছে যে, ‘কোনো ব্যক্তি অণু পরিমাণ ভালো কাজ করলে তার ফল পাবে আর যে ব্যক্তি অণু পরিমাণ খারাপ কাজ করবে, তাও সে দেখতে পাবে।’ আমরা মুমিনরা সত্যের সাক্ষ্য হিসেবে প্রতিটি ভালো কাজ বা দায়িত্বের আমানত রক্ষা করব এবং বিনিময়ে দুনিয়া ও আখিরাতের সুফল ভোগ করব, ইনশাআল্লাহ। নবী মুহাম্মদ সা. বলেছেন, ‘যার মধ্যে আমানতদারির গুণ নেই, তার মধ্যে ঈমান নেই এবং যার মধ্যে প্রতিশ্রুতি রক্ষার গুণ নেই, তার মধ্যে দীনদারি নেই।’ Ñবায়হাকী।
নামাজের ব্যাপারে কিছু কথা পূর্বেই বলা হয়েছে। এখানে ঈমানদারের লক্ষণ হলো নামাজগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ করা। এর অর্থ হলো মুমিনগণ নামাজের সময় নামাজের নিয়মকানুন, আরকাম ও আহকাম মোটকথা নামাজের সাথে সংশ্লিষ্ট প্রত্যেকটি জিনিসের প্রতি পুরোপুরি নজর রাখা। শরীর ও পোশাক পাক রাখা। অজুর প্রতি সচেষ্ট থাকা। নামাজ পড়ার সময় মনে রাখতে হবে যে, আমি মহান আল্লাহর দরবারে হাজির হয়েছি অর্থাৎ আমি আল্লাহকে দেখছি অথবা মহান আল্লাহ আমাকে দেখছেন। নামাজ কায়েমের ব্যাপারে দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হবে। নামাজের সময় পুরোটাই এককেন্দ্রিক হতে হবে। মনে করতে হবেÑ এটাই আমার হয়তো শেষ নামাজ বা আল্লাহর কাছে শেষ হাজিরা। পরকালের বিশ্বাস তো থাকতেই হবে।
ঈমানদাররা উপরোক্ত কাজগুলো যথাযথভাবে করলে এর বিনিময়ে উত্তরাধিকার হিসেবে জান্নাতুল ফেরদাউস পাওয়া যাবে এবং সেখানে চিরদিন থাকার ব্যবস্থা হবে। সর্বক্ষেত্রে সহীহ নিয়ত অত্যন্ত জরুরি। এক্ষেত্রে শিরকমুক্ত একমাত্র আল্লাহকেই রাজি-খুশি করার জন্য কাজ করতে হবে। রমাদান মাসে বদর যুদ্ধ সংঘটিত হয়। তাই ইসলাম কায়েমে সর্বাত্মক চেষ্টার প্রশিক্ষণও এ মাস থেকে পাওয়া যায়।
মানবজাতির জন্ম ও দুনিয়ায় তার কাজকর্ম এবং সফলতা ও ব্যর্থতার পরিণাম জান্নাত এবং জাহান্নাম। গোটা জাতিকে মহান আল্লাহর দিকে ডাকা এবং সে অনুযায়ী জীবনবিধান কার্যকরী করার মাধ্যমে ইসলামই একমাত্র বিধান এবং তার কার্যকারিতার ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েই আমাদের ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের সব কাজ সমাধানের জন্য নিজেদের তৈরি করতে হবে এবং দুনিয়াকে আল কুরআনের আলোকে সাজাতে হবে।
আল কুরআন নাজিলের মাসে আমাদের নীতি-নৈতিকতা, ভালো-মন্দের বিচার সর্বক্ষেত্রে প্রশিক্ষণ নিতে হবে। রমাদানের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রতিটি পদক্ষেপ হতে হবে আমাদের প্রশিক্ষণের অন্তর্ভুক্ত। এ মাসের প্রশিক্ষণের ফলে বাকি এগারো মাস তা বাস্তবায়নের চেষ্টা থাকতে হবে। এ মাসের শেষ দশ দিনের বেজোড় রাতে শবেকদর খুঁজতে হবে। গোটা মাসটাই প্রশিক্ষণের আওতায় এনে শারীরিক, মানসিক ও আর্থিক সর্বক্ষেত্রে অনুকরণীয় ও অনুস্মরণীয় পন্থা বের করতে হবে। মহান আল্লাহ রমাদানের শিক্ষা ও কার্যকারিতা আমাদের জীবনে বাস্তবায়ন করে দুনিয়ার সাফল্য ও আখিরাতের অফুরন্ত এবং সীমাহীন সুখ ও শান্তির নীড় বানানোর তাওফিক দান করুন।
এবারের রমাদানে ঢাকার অভিজাত এলাকা ধানমন্ডির রাস্তায় এক অভিনব এবং প্রশংসিত কাজ চোখে পড়লো। কয়েকজন যুবক একই কাপড় পরে, একটি আধা টনি ট্রাকে নিত্যপ্রয়োজনীয় খাবার ও আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র সাজিয়ে সাধারণ মানুষের কাছে বিক্রি করছেন। ট্রাকের গায়ে বড় ব্যানার টাঙানো। লেখা “রমাদান উপলক্ষে লাভ ছাড়া জিনিসপত্র বিক্রয় হচ্ছে।” দেখে খুবই ভালো লাগলো। বিগত ৫০ বছর আমি এ এলাকায় চলাফেরা করি। এ ধরনের ব্যাপার চোখে পড়েনি। কিছু দূর এগিয়েই একটি দোকানে টকদই কেনার জন্য দাঁড়ালাম। দোকানদার বললো, স্যার রমাদান উপলক্ষে আকিজ গ্রুপের পণ্য “ফার্ম ফ্রেশ” দুধ আধা কেজিতে ১০ টাকা ছাড় দিয়েছে। আলহামদুলিল্লাহ পড়লাম। আমাদের দেশেও অন্যান্য দেশের মতো ব্যবসায়ীরা রমাদানের গুরুত্ব বুঝতে শুরু করেছে। আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করলাম এবং দোয়া করলাম, হে আল্লাহ! আমাদের দেশের সব ব্যবসায়ীকে রমাদানের গুরুত্ব বুঝে মানুষের কষ্ট লাঘব করে আল্লাহকে খুশি করার জন্য কাজ করার তাওফিক দান করো। মহান আল্লাহ রিজিকের মালিক।
বর্তমানে গোটা দুনিয়ায় করোনা ভাইরাস ছোট-বড়, ধনী-গরিব, রাজা-প্রজা সবাইকে নাস্তানাবুদ করে ফেলেছে। লকডাউনের ফলে ক্ষুব্ধ ব্যবসায়ী, দিনমজুর, খেটেখাওয়া মানুষ পথে বসেছে। এ ব্যাপারে মূলত মহান আল্লাহর দরবারেই রোগ-বালাই থেকে মুক্তির জন্য কায়মনে দোয়া করতে হবে। মূলত সকল কাজে মহান আল্লাহ আমাদের অভিভাবক এবং তিনিই একমাত্র সাহায্যকারী, কোনো সন্দেহ নেই। শুধু আমাদের দেশে নয়, গোটা দুনিয়ায়; বিশেষ করে মুসলিম দুনিয়ায় রাষ্ট্রপ্রধানগণসহ সাধারণ মানুষকে নিয়ে আল্লাহর কাছেই হাজিরা দিতে হবে। মাফ চাইতে হবে। রোগ-শোক থেকে মুক্তি চাইতে হবে। আল্লাহ সর্বশক্তিমান। সব কাজে মহান আল্লাহ আমাদের সহায় হোন এবং উত্তম জাজা দান করুন৷ আমিন

Comments

Popular posts from this blog

The virtue of remembrance

উত্তম কথা ব্যতীত অন্য কথা হতে জবানকে হেফাজত করা৷

আরবি শিক্ষা খুব দারুণ একটি বই৷